- মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪

| বৈশাখ ১৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

মুখোশ (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

ইয়াসমিন হোসেন

প্রকাশিত: ২১:০৫, ১৩ এপ্রিল ২০২২

মুখোশ (দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

দুই.
মিনা নামের মেয়েটি ছিল উপজাতীয়। দেখতে একেবারে বাচ্চা বয়সী। ইংরেজিতে মাস্টার্স। সে হঠাৎ না বলে-কয়ে রিজাইন লেটার দিয়ে দিল। কলিগদের কাওকে জানায়নি। মেয়েটির পিছনে ছুক ছুক করে লেগে থাকতো গোলাপ। ৫টা পর্যন্ত অফিস, কিন্তু বেচারাকে নিজের রুমের মধ্যে আটকে রাখতো রাত ৭টা-৮টা পর্যন্ত। অফিসের কেও ৫টার পর থাকতো না। বোঝাই যাচ্ছিল বেচারা অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল। রিজাইন লেটার দিয়ে মেয়েটি কাওকে কোন কথা না বলে বিদায় হয়ে চলে যায়। ঠিক এভাবে ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে বিদায় হয়েছে আরও ৪ জন, তার মধ্যে একজন ছেলেও ছিল। সবাই মাস্টার্স এবং কাজের দিক থেকে সর্ববিষয়ে ছিল সুদক্ষ। গোলাপটা কি শুরু করেছে এসব ভেবে পায় না খালেদ।
হঠাৎ একই ঘটনা ঘটলো নীলাদির বেলায়। সকাল বেলা এসে কালো মুখে বললেন, আমিও রিজাইন লোটার দিচ্ছি আজ। আপনারা আমার অপরাধ থাকলে ক্ষমা করে দেবেন। খালেদদের কারও মুখে কোন কথা নেই। তিনিও চলে গেলেন। মজার ব্যাপার হলো বস আপা নিজের ঘনিষ্ট এই নীলাদিকে ডেকে একটি বারের জন্যও প্রশ্ন করলেন না যে, কেন সে রিজাইন দিচ্ছে। কথা বলতেই সময় দিলেন না তাকে। একই ঘটনা ঘটেছে অন্যান্যদের বেলায়ও।

তিন.
-    এবার কার পালা তিনু?
-    আমার খালেদ ভাই। যতো তাড়াতাড়ি পারি পালাতে পারলে বাঁচি।
-    তা-ই।

আর কোন কথা বললো না খালেদ। ভাবছিল নিজের হাতে তৈরি অথচ নষ্ট হয়ে যাওয়া গোলাপ নামের কর্মীটির কথা। এক সময়ের লীডার হয়েও ও আজ অপদস্ত। কোন ভাল মানুষ কি কখনও তার লীডারকে অসম্মান করে? করে না।
-    আপনি কি জানেন সে আমার সঙ্গে কি আচরণ করে?
-    কিছুটা অনুমান করি। সে চায় অফিস ছুটির পর সবাই চলে যাবার পরও আপনি তার পাশে সময় কাটান এই আরকি।
-    এইটুকু মোটেই নয়। আমাকে তার রুমে ডেকে নিয়ে কাজের কথা বাদ দিয়ে হেয়ালীপূর্ণ এমন সব কথা বলে যা ভাবতে পারবেন না। গায়ে গা লাগিয়ে বসার চেষ্টা করে। আরওসব আছে- বলতে  পারবো না। সব সময় আমাকে বিরক্ত করে। আর কাজ কি করে তা তো দেখেনই। অফিসে হাজির হওয়ারও তার কোন সময়জ্ঞান নেই। বস আপাকে দেখানোর জন্য কাজ শুরু করে বিকেল ৫টার পর এবং রাতে অফিসে ১০টা-১১টা পর্যন্ত কাটিয়ে দেখায় যে সেই-ই একমাত্র এভাবে কাজ করে। অফিস এবং কাজের প্রতি কী দরদ তার! আসলে আড্ডা দেওয়া আর কূট-পরিকল্পনা করা ছাড়া কিছুই করে না।
-    জানি। কিন্তু এগুলো বস আপা কেন বোঝেন না সেটাই প্রশ্ন?
-    বোঝেন এবং সবই জানেন। জেনেও না জানার ভান করে থাকেন। এখানে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, যৌথচিন্তা-ধারা, সমআধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রত এসব মিথ্যা কথা। এগুলো বলে ধোকা দেওয়া হয়। একটা কথা বলি, রাগ করবেন না।
-    না, বলুন।
-    এসবের জন্য আপনারা দায়ি। বিশেষ করে আমাদের সেকশনের জন্য আপনি দায়ি।
-    আমি? কি বলেন? কিভাবে?
-    সে আপনার বস হলেও আসলে সবদিক থেকে আপনি তার সিনিয়র, সম্মানী এবং তার ছোটবেলার সঙ্গী। আপনি তাকে শাসন করতে পারেন। কিন্তু করেন না। করেন না বলেই সুযোগগুলো পেয়েছে।
-    দেখুন, আমি ওর লীডার ছিলাম বটে। কিন্তু এখন কি আচরণ করছে দেখতেই তো পাচ্ছেন। তারপরেও আমি নানাভাবে তাকে তার ক্রুটিগুলোর কথা বলি একা পেলেই। হয়তো এতে সে খুব অসন্তুষ্ট হয়। হলেও আমি বলি।
-    না, আরও যেভাবে বলা উচিত, করা উচিত তা করেন না। তা ছাড়া আপনি সারাজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বড় হয়েছেন, কোথাও আপোস করেননি। কিন্তু গোলাপ সাহেবের বেলায় করছেন। নিজের লোক বলে? এটা আমার অভিযোগ আপনার প্রতি। একান্ত নিজের মানুষ মনে করেই এটা অকপটে আপনাকে বলছি। 
অনেকক্ষণ কথা বললো না খালেদ। 

তিনুও একেবারে বাচ্চা মেয়ে। যদিও ইংরেজিতে ডাবল মাস্টার্স, ফরাসীসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় দক্ষ, কম্পিউটারে দক্ষ, অফিসিয়াল কাজ-রবীন্দ্র সঙ্গীত-আবৃত্তি-পর্যটন ইত্যাদিতেও এক কথায় সর্ব বিষয়ে সু-দক্ষ। ফলে ওর কাছে গোলাপের সব ফাঁকিবাজি কাজ ধরা পড়ে যায়। প্রশাসনিক বিভাগে প্রকাশ হয়ে পড়ে এসব ফাঁকিবাজি। 
খালেদ এই চাকরিতে কোন উচ্চাশা নিয়ে আসেনি। ও যেখান থেকে এসেছে বা দায়িত্ব পালন করে এসেছে তা অনেক উচু পর্যায়ের। খোদ বস আপাও আজ এতো উঁচু পর্যায়ের নয়। সুতরাং এখানে খালেদের কোন উচ্চাভিলাষের কিছু নেই। অবশ্য খুব ছোট পর্যায়ে থাকা গোলাপের বেলায় যে এমনটি হবে তাতো নয়। সে এখানকার উপরে ওঠাকেই বিরাট কিছু মনে করতেই পারে এবং করছেও। তাই তার অনেক কূটনীতি অফিসকে নিয়ে। আর বানরের হাতে খন্তা পড়লে যা হয় বস আপা তাকে সেই খন্তাটা তুলে দিয়েছেন বলেই যতো বিপাক। কিন্তু প্রশ্ন হলো তিনি তা দেবেন কেন, কোন্ স্বার্থে? একটা কিছু তো থাকতে হবে..........

চার. 
অফিসে গুরুতর অবস্থা। দিনটি ছিল শুক্রবার। সরকারীভাবে ছুটির দিন। কিন্তু এ অফিস খোলা থাকে। সরকারী ছুটি মানা হয় না। বলা হয় আমরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি না, তাই শুক্রবারে ছুটি মানি না। এই দিনে গোলাপ এসে অসুস্থ তিনুকে বলে গেল, ছুটির পরে থাকতে হবে। তিনু বলেছিল, ‘একেতো আমি অসুস্থ, জোর করে অফিস করছি, তাছাড়া আমার পারিবারিক প্রোগ্রাম আছে, থাকতে পারবো না।’ তারপর ও থাকেনি। থাকেনি বলে গোলাপ ওকে ফোন করে আপত্তিকর কথা বলেছে। হুমকী দিয়েছে, দেখে নেবে বলেছে। 
তিনু ফোন করে খালেদকে সব জানিয়েছে। বলেছে, ‘গোলাপ সাহেব আমাকে হুমকি দিয়েছে, অনেক বাজে বাজে কথা বলেছে। আমি আর চাকরী করবো না। রবিবারে অফিসে গিয়ে রেজিগনেশন লেটার দেবো।’

রবিবার। তিনু সকালে না এসে দুপুর বেলায় অফিসে এসেছে, বস আপা উপস্থিত হওয়ার পর। তখনই তিনু রেজিগনেশন লেটার জমা দিতে যায়। অবাক ব্যাপার! তিনুর কোন কথা শোনা তো দূরে থাক, অত্যন্ত অশালীন ব্যবহার করে ওকে বিদায় করে দিয়েছেন বস আপা। 
তিনু মেয়েটি ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে পুরো বৃষ্টির ভিতরে বের হয়ে চলে যায়। ওর বিদায়ে কলিগরা তখন ওর মতোই কাঁদছিল অঝোরে। ওকে সব মেয়ে কলিগই ভালবাসতো। 

বোঝাই যায় আগে থেকে বস আপাকে ম্যানেজ করে রেখেছিল গোলাপ।

পাঁচ.
খালেদ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এখানে আর নয়। দীপালিও একই মন্তব্য করলো। রাতে ফোন করে নিজের কথাটা তিনুকে জানালো খালেদ। তিনু বললো, ‘সিদ্ধান্তটা তাড়াতাড়ি বাস্তবায়ন করলে ভাল করবেন। কারণ ওরা খুব খারাপ। ভিতরে লুটপাটের একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। বুঝতেই পারছেন ডোনারদের বিশাল অঙ্কের ফান্ড। যখনই ওই সিন্ডিকেট বুঝে ফেলছে যে ওরা কারও কারও কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে তখনই তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিচ্ছে। তাই আপনাকে অপদস্ত করার আগেই পদক্ষেপ নিতে হবে।’ খালেদ বলেছিল, ‘হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি নেবো, এ মাসেই, পারলে আরও তাড়াতাড়ি।’

গোলাপের একটা কথা মনে পড়লো। সে খালেদকে বলেছিল, ‘আপনার প্রশ্নের জবাব সময়মতো দেবো।’ কলিগদের কিছু না জানিয়ে বস আপার সঙ্গে কথা বলে ও একমাাস বিদেশে কাটিয়েছে। খালেদ তখন ওকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিল। বলেছিল, ‘জবাবদিহিতার দোহাই দেওয়া হয়, তুমি এখন জবাব দাও কেন না বলে গেছো? নিজের সেকশনের কলিগদের তো জানার অধিকার আছে কোথায়-কেন গেছো? অন্যদেরকে তো আমাদেরও জবাবদিহি করতে হয়।’ 
তখন ও বেশ প্রতিশোধমূলক ভঙ্গিতে ওই কথাটা বলেছিল যে, সময়মতো জবাব দেবে। ওইসময় খালেদ এটাকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। হঠাৎ মনে হলো ও হয়তো প্রতিশোধ নেবে। হোক একান্ত আপনজন, তারপরেও। গোলাপ মাঝে মাঝেই বলেছে, ‘আমি ভালোর ভাল, খারাপের খারাপ।’ এ কথা দিয়ে খালেদকে হয়তো বোঝাতে চেয়েছে লীডার এবং কমরেড হলেও ও খারাপটাই করবে। যদিও সত্যি কথা হলো, খালেদ কখনই গোলাপকে খারাপ দেখতে চায় না বলেই সতর্ক করতে চেয়েছে, ভাল করতে চেয়েছে। তাছাড়া সত্যি কথা হলো, এতো কিছুর পরেও খালেদ ওর ভালটার জন্যই চেষ্টা করবে। প্রাণপণে ওকে বাঁচাবে খালেদ। এটাই হয়তো বুঝে তিনু বলেছিল, ‘বন্ধু বলে’ ওকে কিছু বলে না। কথাটা সত্যি। কারণ ওযে একসময়ের প্রাণের চেয়েও ভালবাসার মানুষ। তার কি খারাপ চাওয়া যায়? যায় না। এখানে কখনই গোলাপের ভাষ্যমতো ‘খারাপের খারাপ’ হতে পারবে না, এ চরিত্রের মানুষও নয় খালেদ।
কিন্তু গোলাপ? সে কি মানুষ আছে? খালেদ তখনও জানেনি, মানুষ যখন পশু হয় তখন সে সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়।

পরদিন। খালেদ অফিসে ঢুকে বুঝতেই পারেনি গোলাপ কতোটুকু খারাপ পদক্ষেপ নিতে পারে। আর বস আপাও সকল রীতি-নীতি ভঙ্গ করে গোলাপের কথা মতো চলতে পারেন। 
অফিসে ঢোকার কিছুক্ষণ পর পিয়ন দিলশাদ এসে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো। সেটা খুলে দেখলো, খালেদকে চাকরী থেকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। কোন কারণের কথা নেই। স্বাক্ষর করেছেন বস আপা।

ছয়.
গোটা অফিসে এখন কান্নার রোল। কেও কেও তীব্র ঘৃণায় বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। যারা কাঁদছে তাদের ফোপানীর শব্দে বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। কান্না এবং ঘৃণার মিলনমেলা চলছে। এই মেলা চলছে রিপোর্ট সেকশনে, একাউন্টস সেকশনে, প্রশাসন বিভাগে, ব্যক্তিগত বিভাগে, ডকুমেন্টস বিভাগে, সেন্ট্রাল টিম, লাইব্রেরি ও সেবাকর্মীদের মধ্যে। সবাই চোখের জলে ভালবাসা, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার বহ্নিপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। খালেদকে বিদায় জানাতে এ এক অন্য রকম দৃশ্য। কেও কেও অনেকটা চিৎকার বলেই ফেললো, এতো গণতন্ত্রায়ন-ভয়েজ চর্চার কথা বলা হয় আজ কি দেখা গেল? কোথায় গণতন্ত্র চর্চা, কোথায় অধিকারের প্রশ্ন, ভয়েজ তৈরির চর্চা, কোথায় যৌথ কর্মকা-ের উদাহরণ? বস আপা আর গোলাপ মিলে কি এই পদক্ষেপ নিতে পারেন? স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর এই কি উদাহরণ? সব ভাওতা? আসল রূপ বেরিয়ে পড়লো।
খালেদ কোন জবাব দেয়নি। বেরিয়ে এসেছে। 

সাত.
খবর শুনেই ফোন করেছে তিনু। কোন কথা বলতে পারছে না। শুধু হাউমাউ করে কাঁদছে। কথা যতোটুকু বোঝা যাচ্ছে ‘এটা কি করে সম্ভব? আপনার মতো মানুষকেও ওরা এই কাজ করলো?’ 
খালেদ ওকে শান্ত হতে বলছে। কিন্তু ওকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। কান্নার বাধ যেন ভেঙে পড়েছে। খালেদ বলছে, ‘আপনি থামুন। এখন শান্ত হোন। ফোনটা রাখুন। শান্ত হওয়ার পরে একসময় কথা বলবো। 
ও শুধু ‘না না’ করছে। আর বলছে, ‘আমি ভাবতেও পারিছ না, মানুষ এতো নিকৃষ্ট হতে পারে? এতো খারাপ জায়গায় আমরা ছিলাম?’ 
‘হ্যাঁ তিনু, আমরা খারাপ জায়গায় ছিলাম, সেখান থেকে মুক্ত হয়েছি, এটা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। আর আমরা যে ভাল মানুষ ছিলাম তার প্রমাণ সবার চোখের জলেই পাওয়া গেছে। অফিসের অর্ধশত স্টাফের সবাই আমাদের ভালবাসতো, পছন্দ করতো। তাঁরা আমাদের জন্য কেঁদেছে। আপনি ভাবুন, আমাদের মতো কখনও যদি গোলাপ সাহেবদেরকে অফিস থেকে বিদায় হতে হয় তখন তাদের জন্য কি কেও এভাবে চোখের জল ফেলবে? ফেলবে না। বরং ওইদিন অফিসে আনন্দ উৎসব হবে। আমাদের বিপরীত একেবারেই। এরচেয়ে স্বস্তির আর কি আছে? আর বস আপা? তিনি তো মুখোশটা খুলে সবার সামনে নিজেকে প্রকাশ করে দিয়েছেন। এরপর অফিসের বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়বেন। আর কি চাই? আপনি এখন শান্ত হোন। ফোন রাখুন।’ 
তিনু ফোন রাখে না। শুধু হু হু করে কাঁদছে আর কাঁদছে। চোখের জলে সিক্ত করে দিতে চাইছে।  অসভ্যতার বিরুদ্ধে এ এক অসাধারণ প্রতিবাদ।

 

ইয়াসমিন হোসেন

ফ্রিল্যান্স লেখক

আর এ