- শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪

| জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

সুখ (পর্ব-১)

সানজিদা ইসলাম সেতু

প্রকাশিত: ২১:৫৯, ১৩ এপ্রিল ২০২২

সুখ (পর্ব-১)

এক হাতে প্রেগন্যান্সির পজিটিভ রিপোর্ট, আর অন্য হাতে ডিভোর্স পেপার নিয়ে বসে আছে দীপ্তি। কিছুক্ষণ আগেই দুটো পেয়েছে। রিপোর্টটা হাতে নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় খুব হাসিখুশি ছিল দীপ্তি, ভেবেছিলো এবার হয়তো সবটা আগের মতো হয়ে যাবে। কিন্তু বাড়ি ফিরতেই রিসাদ ডিভোর্স পেপার রেখে যায়,তা'ও আবার রিসাদের সিগনেচার করা।

শুধু পেপারটা দিলে নাহয় প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দিয়ে রিসাদের সিদ্ধান্ত বদলাতে পারতো দীপ্তি, কিন্তু রিসাদ তো কয়েক কদম এগিয়ে গেছে।

রিসাদকে বাবা হবার সুসংবাদ দেয়ার ইচ্ছেটা হারিয়ে গেছে দীপ্তির। সারা রাত বসেই কাটিয়েছে। রিসাদ পেপার দিয়েই চলে গেছিলো আর বলেছিল,

'ডিভোর্স পেপারে আমি সাইন করে দিয়েছি, তুমিও করে দিও। আর এসে যেনো তোমাকে এ বাড়িতে দেখতে না পাই।'

(বিঃদ্রঃ আমাদের ইসলাম ধর্ম মতে গর্ববতী অবস্থায় ডিবোর্স হয়না। গল্পটা কাল্পনিক)

সারারাত বাড়ি ফেরেনি রিসাদ। ফজরের আজান শুনা মাত্রই দীপ্তি নামাজ পরে নেয়, মোনাজাতে শুধু রিসাদের ভালো থাকা চেয়েছে, সব সময়ের মতো।

নামাজ পরে ফোন দেয় দীপ্তির অফিসের কলিগ রিতাকে। বয়সে ওর চেয়ে ৪ বছরের বড় আর বিধবা, ৩ বছরের একটা মেয়ে আছে। স্বামী মারা যাবার পর শ্বশুর বাড়ির সাথে যোগাযোগ রাখেনি ,আর তারাও রাখেনি খুজ। অফিসের পাশেই নিজস্ব ফ্ল্যাটে থাকে। দীপ্তিকে সে বড়ই স্নেহ করে।

এত সকালে দীপ্তির ফোন পেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে যায় রিতা। কিছু হল না তো?

দীপ্তিঃ 'রিতা আপু।'

রিতাঃ 'দীপ্তি তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো?'

দীপ্তিঃ 'আপু তোমার বাসায় আমাকে কিছুদিন থাকতে দিবে? খুব তাড়াতাড়ি নতুন বাসা খুঁজেই আমি চলে যাব।'

'এ সব কি বলছিস তুই?কি হয়েছে? '

'রিসাদ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছে।'

কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকে রিতা, পরে বলে,

'আমি গাড়ি নিয়ে আসছি, তুই রেডি থাক। খবরদার আমি না আসা পর্যন্ত যাই হোক না কেনো বাড়ি থেকে বের হবি না।'

দীপ্তিঃ 'হুম।'

'আরেকটা কথা, কিছুতেই ডিভোর্স পেপারে সিগনেচার করবি না।'

'সরি, আপু, সরি।'

দীপ্তি ফোন কেটে দেয়।

ফোন রেখে কাগজ-কলম নিয়ে বসে দীপ্তি । একটা চিঠি লেখে রিসাদকে। চিঠি বললে ভুল হবে, তার চেয়ে চিরকুট বলা ভালো।

'প্রিয় রিসাদ

ভালো থেকো তুমি। আমি আমার প্রয়োজনীয় সব জিনিস নিয়ে গেলাম, কিন্তু ভালোবাসার ঘরে তোমাকে রেখে গেলাম, সাথে রেখে গেলাম ৬ বছরের ভালোবাসা। তুমি আমাকে এমন একটা খাদের সামনে এনে দাড় করিয়েছ যেখানে লাফ দেয়া ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।

আমি প্রেগন্যান্ট রিসাদ। রিপোর্টটা পাশে রেখে গেলাম। তুমি যা করেছ তার পর আমি আশা করব তুমি কখনো তোমার সরি আর আমার সন্তানের দাবী নিয়ে আমার সামনে দাড়াবে না।

তোমার বিরক্তির

দীপ্তি.. '

চিরকুটটা লিখে কান্নায় ভেঙে পরে দীপ্তি। একহাত দিয়ে চোখের পানি মুছে অন্য হাত দিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করিয়ে দেয়। কলমের একটা খোঁচায় শেষ হয়ে গেলো দুটো মানুষের ছয় বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক আর ২ বছরের বিবাহিত জীবন।

বাবা-মায়েদের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করেছিলো রিসাদ আর দীপ্তি। এতে দুজনকেই পরিবার থেকে বিতাড়িত করা হয়। ৪ বছরের প্রেম ছিল দুজনের, নিজেদের ভালোবাসার কথা পরিবারকে জানানোর পর পরিবার থেকে মেনে না নেয়াতে দুজনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করে। দীপ্তি আর রিসাদ দুজনেই স্বাবলম্বী ছিলো। তাই নতুন সংসার গড়তে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। বেশ ভালোই চলছিলো তাদের টুনাটুনির সংসার,ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলোনা সেখানে।

কিন্তু বাবা-মা’কে কষ্ট দিয়ে জীবনে সুখী হওয়া যায় না। তাদের মনের কষ্ট নিয়ে ফেলা একটা দীর্ঘশ্বাসও সন্তানের জন্য অভিশাপ স্বরূপ।

তেমনি অভিশাপ হয়ে দীপ্তি আর রিসাদ এর জীবনে এলো রিয়া,, রিয়া হচ্ছে রিসাদের অফিস কলিগ। রিয়া নিজের রুপে রিসাদের চোখে রঙিন চশমা পরিয়ে দেয়, যেটাতে দীপ্তিকে বড়ই বেরঙিন লাগে। শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে মন মালিন্য, দীপ্তির প্রতি কমতে থাকে রিসাদের খেয়াল, ভালোবাসা,কেয়ার। প্রায় রাতেই রিসাদ দেরি করে আসতো। ভালোবাসায় অন্ধ দীপ্তির চোখ আর মন ভাবতো কাজের ব্যস্ততার জন্য এমন হচ্ছে। ওর মনে ভুলেও কখনো এটা আসেনি যে রিসাদ কখনো ওর থেকে দূরে যেতে পারে,

রিসাদের মনে দীপ্তি ছাড়া অন্য কাউকে জায়গা দিতে পারেনা। কিন্তু সেদিন থেকে ভাবতে শুরু করেছিলো, যেদিন রিসাদের শার্টে লিপস্টিক এর দাগ আর ওর শরীরে মেয়েদের পারফিউম এর ঘ্রাণ পেয়েছিলো, আর রিসাদ সেটা এড়িয়ে গিয়েছিলো। এরপর প্রায়ই লিপস্টিক এর দাগ আর মেয়েদের পারফিউম এর ঘ্রাণ পেতো।

বেশ কয়েকবার এ নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় দুজনের। কিন্তু রিসাদ দীপ্তিকে সন্তুষ্ট করার মতো কোনো উত্তর দিতে পারত না, কোনো রকমে সবটা এড়িয়ে যেতো। কয়দিনই বা রিসাদ সবটা এড়াত! একদিন না একদিন সামনে আসতই।আর সেটাই হলো।

রিসাদের অবর্তমানে একদিন রিয়া আসে ওদের বাড়িতে।

'কে আপনি?'

'আমি রিয়া,এ বাড়ির পরবর্তী কর্তী।'

'মানে?'

'মানে, আমি আর রিসাদ একে অপরকে ভালোবাসি। শীঘ্রই বিয়ে করব।'

'কি সব বাজে কথা বলছেন আপনি? আমি রিসাদের ওয়াইফ আর রিসাদ আমাকে ভালোবাসে।'

'ভালোবাসত..হ্যাঁ ও তোমাকে ভালোবাসত আর সেটা পাস্ট, এখন আমি ওর পেজেন্ট এন্ড ফিউচার।'

দীপ্তিঃ 'আপনার আর কিছু বলার আছে? না থাকলে আসতে পারেন দরজা খোলা আছে।'

'যাব, তার আগে আমার গায়ের এই পারফিউম এর ঘ্রাণটা নাকে নাও তো, দেখো তো চেনা চেনা লাগে কি না?'

দীপ্তি তখন দুপা পিছিয়ে যায়। এটাতো সেই ঘ্রাণ যেটা দীপ্তি প্রায়ই রিসাদের শরীরে পায়।

রিয়াঃ 'শোনো দীপ্তি তোমায় একটা কথা বলি, আমার আর রিসাদের মাঝ থেকে সরে যাও। যত টাকা চাও পাবে।'

দীপ্তিঃ 'আপনি এখনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, এখনি।'

'ওকে ওকে, বায়।'

সেদিন রিসাদ বাড়ি ফিরলে দীপ্তি সমস্ত ঘটনা ওকে জানায়। রিয়া বাড়িতে আসলো শুনে রিসাদ অস্থির হয়ে যায়, ঘামতে শুরু করে।

দীপ্তিঃ 'কি হল রিসাদ তুমি কিছু বলছ না কেন?

সেদিনও রিসাদ সবটা এড়িয়ে যায়।

কিন্তু সত্যি আর কতদিন লুকানো যায়,একদিন না একদিন তো সামনে আসবেই,

রিসাদ একদিন রিয়াকে বাড়িতে নিয়ে আসে আর দীপ্তিকে বলে,

'আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে রিয়াকে বিয়ে করব। তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে আমাদের মাঝ থেকে সরে দাড়াও।'

সেদিন দীপ্তি কিছু বলতে পারেনি।চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিলো। বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে দূরত্ব, দীপ্তি চেষ্টা করেছিলো সবটা বদলাতে কিন্তু ব্যর্থ হয়। যার ফলস্বরূপ আজ এই বিচ্ছেদ।

বাইরে গাড়ির আওয়াজ পায় দীপ্তি, রিতা আপু এসেছে। রিতা এর আগেও এ বাড়িতে এসেছে, তাই দীপ্তির রুম চিনতে অসুবিধা হয়নি।

দরজায় এসে থমকে দাড়ায় রিতা। দীপ্তি বিছানায় মাথা রেখে মেঝেতে বসে আছে, মুখ ফুলে আছে, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে, দৃষ্টি সিলিং এ ঝুলে থাকা পাখার দিকে আর হাতে একটা শাড়ি। এসব দেখে বুক কেঁপে ওঠে রিতার, বুঝতে পারে কি হতে যাচ্ছিলো এখানে।

দরজার কাছে দুটো ব্যাগ দেখে ড্রাইভারকে ডাকে। রিতা এসে দীপ্তির পাশে বসে।

'দীপ্তি আমাদের যেতে হবে চল।'

রিতার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হাসে দীপ্তি। দীপ্তির মানুষিক আর শারীরিক অবস্থা বুঝতে পেরে রিতা ওকে ধরে নিয়ে যায়। সারা রাস্তায় একটা কথাও বলেনি দীপ্তি। রিতার বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে শুয়ে পরে। রিতা অফিস থেকে নিজের আর দীপ্তির ছুটি নিয়ে নেয়। রিতা কৌশলে দীপ্তিকে ঘুমের ওষুধ খায়য়ে দেয়। ব্যাগ খুঁজে মোবাইল বের করে সেটা মিউট করে রাখে।

এদিকে রিসাদ বাড়িতে আসলো। বাড়ির দরজায় দাড়িয়ে রিসাদের মনে হচ্ছিলো দীপ্তি বাড়ির ভিতরে আছে। কিন্তু ভিতরে এসে চারদিক চোখ বুলিয়ে দেখে, কিন্তু দীপ্তি নেই।চেঞ্জ করার জন্য বেডরুমে যায়। কাবার্ড থেকে কাপড় নিয়ে বাথরুমে যায়। বের হয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে মাথার চুল নাড়তে নাড়তে গুনগুনিয়ে গান গাইতে থাকে। তখন নজর পরে বিছানার উপর তিনটি কাগজ পাশাপাশি রাখা।

কাগজ তিনটি হাতে নিয়ে বলে,

'একটা ডিভোর্স পেপার, নিশ্চয়ই সাইন করেছে। এটা দেখে মনে হচ্ছে চিঠি, নিশ্চয়ই ওর ওই তুচ্ছ কথা গুলো। কিন্তু এই এনভেলপ এ কি আছে? খুলে দেখিতো মেডাম কি রেখেছে এতে।'

এনভেলপ খুলে দীপ্তির প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট পরে রিসাদ। চোখ ঠোকর থেকে বের হবার জোগার, মাথা এলোমেলো হয়ে গেছে ওর। পরে চিঠিটা পড়ে।

মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। কি করবে সে সেটাই ভাবতে থাকে। দীপ্তি স্পষ্ট ভাবে লিখে গেছে, সন্তানের দাবী নিয়ে যেনো ওর সামনে না দাড়ায় রিসাদ। ফোন হাতে নিয়ে দীপ্তির নাম্বারে ডায়াল করে, কিন্তু ও রিসিভ করে না। করবে কি করে, রিতা তো ফোন মিউটে রেখেছে।

চলবে.......

আর এ