- মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪

| বৈশাখ ১৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

কৃষিখাতে বিপ্লব ঘটাতে পারে তিন তরুনের মাটির প্রাণ

‌মো. শামীম রহমান

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১৩ এপ্রিল ২০২২

কৃষিখাতে বিপ্লব ঘটাতে পারে তিন তরুনের মাটির প্রাণ

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে শতকরা ৭৫ ভাগ লোক গ্রামে বাস করে। বাংলাদেশের গ্রাম এলাকায় ৫৯.৮৪% লোকের এবং শহর এলাকায় ১০.৮১% লোকের কৃষিখামার রয়েছে। এদেশের কৃষকরা সাধারণত সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে থাকেন। যেহেতু কৃষিই বাংলাদেশের জনজীবনের প্রধান অবলম্বন সে কারণে দে‌শের অর্থ‌নৈ‌তিক উন্নয়নের জন্য কৃ‌ষি আধু‌নিকায়ন খুবই জরু‌রি। কৃষি এ দেশের অর্থনীতির এক অতি গুরুত্বপূর্ণ খাত। বর্তমানে দেশে জিডিপির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অর্জিত হয় কৃষি খাত থেকে। তার চেয়েও বড় কথা কৃষি এ দেশের জনমানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের প্রধানতম এবং অন্যতম উৎস। এখনও এ দেশের বিপুল জনসংখ্যার কর্মসংস্থানও হয়ে থাকে কৃষিকে অবলম্বন করেই। ফলে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, জীবনযাত্রায় মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে কৃষিক্ষেত্রে অধিকতর মনোযোগ দিতে হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
কৃ‌ষি কাজের জন্য অন্যতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো মা‌টি। ‌কিন্তু আমাদের দেশের কৃষকরা বে‌শিরভাগ শি‌ক্ষিত না হওয়ায় মা‌টির গুনাগুন, উপাদান, কোন মা‌টি‌তে কোন ফসল ভালো হবে, কি প‌রিমাণ সার ব্যবহার করলে ফলন ভালো হবে ইত্যা‌দি বিষ‌য়ে এখনও অজ্ঞ। তাই সাধারণ কৃষকদের কথা চিন্তা করে এবং কৃ‌ষিকে আধু‌নিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশের তিন তরুণ আ‌বিষ্কারক   ‘মাটির প্রাণ’ নামক এমনই ডিভাইস ও অ্যাপস আ‌বিষ্কার করলেন, যা কিনা এই সকল প্রশ্নের সমাধান দিবে।
এই তিন তরুণ হলেন, আব্দুল্লাহ আল আরাফ, রাহাত উদ্দিন ও রেজাউল খান। তারা তিনজনই ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন। তারা তাদের ডিপ্লোমার শেষের দিকে গ্রামে চলে যান। এলাকার যারা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত তাদের সাথে অনেক দিন কাটান তারা।

আব্দুল্লাহ আল আরাফের বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদীতে। ঢাকা পলিটেকনিক থেকে কম্পিউটার টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮ সালে। সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে সিএসসি ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। রাহাত উদ্দিনের বাড়ি চাঁদপুরের মতলব উত্তরের। গ্রামের ইমামপুর পল্লী মঙ্গল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন। এরপর ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ইলেকট্র্রনিকস টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮ সালে। বর্তমানে প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্র্রনিকস ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন করছেন। আরেক গবেষক রেজাউল খানের বাড়ি গাজীপুরে। তিনিও ঢাকা পলিটেকনিকে কম্পিউটার টেকনোলজি বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন ২০১৮ সালে। বর্তমানে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে গ্র্যাজুয়েশন করছেন।

টোকি‌ও বাংলা নিউজের সঙ্গে কথা হয় এই তিন উদ্ভাবকের। নিচে তারই চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো। 

টোকিও বাংলা নিউজ: কিভাবে আপনাদের মা‌টি নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছা হলো?

রাহাত উদ্দিন: কৃষক‌দের মা‌টি সম্পর্কে ধারণা না থাকায় তারা উপযুক্ত ফসল ফলাতে পারেন না। তাই ফসল থেকে উপযুক্ত ফলনও আসে না। এই ভাবনা থেকেই প্রথম চিন্তা ক‌রি, এই  সমস্যা সমাধানে আমরা কাজ করতে পা‌রি। এর পরই আমরা নতুন ফিচার নিয়ে কাজ শুরু ক‌রি। এখন আমাদের ডিভাইস দিয়ে মা‌টির সকল গুন পরীক্ষা করা যায়।

আব্দুল্লাহ আল আরাফ: কৃষকদের ভোগা‌ন্তির কথা চিন্তা করে আ‌মি প্রথমে বন্ধুদের সঙ্গে কথা ব‌লি। আমার এই আইডিয়ার সাথে রাহাত ও রেজাউল একাত্মতা প্রকাশ করেন। এরপর আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করি। গবেষণা করতে গিয়ে দে‌খি কৃষকরা বেশিরভাগ সময় শুধু ধারণার ওপর ভিত্তি করেই জমিতে চাষ, পানি, সার দেয়া ইত্যা‌দি করে থাকেন। যার ফলে বিভিন্ন সময় তারা ভাল ফলন পায় না। তাদের এসব কিছু অ্যানালাইসিস করে আমরা বুঝতে পারি যে, এই সমস্যা সমাধানের একমাত্র উপায় হচ্ছে মাটি পরীক্ষা করে তার ধরণের উপর নির্ভর করে চাষ করলে ফলন ভাল হবে। কৃষকরা বছরের পর বছর ধরে গতানুগতিকভাবে ফসল চাষ করে যাচ্ছেন। আমরা দেখতে পাই বেশির ভাগ কৃষকই মাটি পরীক্ষার বিষয়ে আগ্রহী নয়। এর কারণ হচ্ছে বর্তমানে ফসলের মাঠের মাটি পরীক্ষার জন্য যে পদ্ধতি মানা হয় তাতে অনেক ঝামেলা রয়েছে। কৃষককে মাঠ থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে নিয়ে যেতে হয়। এরপর একটি নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে তার নমুনা মাটি টুকু দিয়ে আসেন পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষার ফলাফল আসতে সময় লাগে ২৫-৩০ দিন। তাই তারা সময় নষ্ট কর‌তে চান না। এর থেকে য‌দি মাটি পরীক্ষার সহজ উপায় কৃষকদের হাতে পৌঁছানো যায় তাহলে কৃষক মাটি পরীক্ষার প্রতি আগ্রহী হবেন।

টোকিও বাংলা নিউজ: কবে থেকে আপনারা কাজ শুরু করেন?

আব্দুল্লাহ আল আরাফ: আমরা তিন বন্ধু মিলে মাটি গবেষণার আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য ২০১৮ সালের মাঝামাঝিতে কাজ শুরু করি। শুরুতেই আমরা কোন-কোন দিক নিয়ে কাজ করব তা ঠিক করি। আমরা আমাদের প্রজেক্টের নাম দেই ‘মাটির প্রাণ’। এই প্রজেক্টটি হচ্ছে কৃষিবান্ধব ডিজিটাল পোর্টেবল সয়েল টেস্টিং ডিভাইস।

রাহাত উদ্দিন: আমরা পুরোদমে গবেষণা চালিয়ে যাই। আমাদের এই ‘মাটির প্রাণ’ প্রজেক্ট নিয়ে থাইল্যান্ড শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি। সেখানে সাতটি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় হওয়ার গৌরব অর্জন করে ‘মাটির প্রাণ’। এরপর সেখান থেকে ফিরে ‘ব্যাসিস ন্যাশনাল আইসিটি অ্যাওয়ার্ডে’ অংশ নিয়ে সিনিয়র স্টুডেন্ট ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হই। ২০১৯ সালে ভিয়েতনামে অনুষ্ঠিত এপিক্টা অ্যাওয়ার্ডে অংশ নিই। এই প্রজেক্টকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অনুদানের জন্য আবেদন করি। এই প্রকল্পে আমাদের মেন্টর হিসেবে আছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রফেসর ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ আল মামুন।

টোকিও বাংলা নিউজ: এই ডিভাইস‌টি কিভাবে কাজ করে?

আব্দুল্লাহ আল আরাফ: এটি বেশ কিছু সেন্সরের সমন্বয়ে গঠিত; যার সাথে একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আছে। কৃষক তার ফসলের মাঠে বসেই মাটি পরীক্ষা করে ফসলের মাঠের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারবেন। কৃষক ডিভাইসটি নিয়ে মাঠে যাবেন এবং জমিতে ৯টি ব্লকে চিহ্নিত করে মাটির নমুনা সংগ্রহ করবেন। সংগৃহীত নমুনা মাটি থেকে দ্রবণ (মিশ্রণ) তৈরি করবেন এবং সেই দ্রবণে 'পিএইচ' সেন্সরের মাধ্যমে মাটির মান নেবেন। এর উপর নির্ভর করে মা‌টির মান জানতে আর্দ্রতা পরিমাপক সেন্সরকে মাঠের মাঝামাঝি স্থাপন করে মাটির আর্দ্রতার মান নেবেন। এরপর মাটির নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও পটাশিয়াম পরিমাপ করবেন। এই ডিভাইস‌টি দিয়ে যে কোন জায়গার মা‌টি পরীক্ষা সম্ভব।

রেজাউল খান: এরপর এর জন্য অ্যাপের কাজ শুরু ক‌রি। মাটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো আমাদের মাটির প্রাণ মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে ইনপুট দেবেন। মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনটি সম্পূর্ণ বাংলায় তৈরি করা। ফলে একজন কৃষক খুব সহজেই এটি ব্যবহার করতে পারবেন। অ্যাপ ইনপুটকৃত তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করে মাটির বর্তমান অবস্থা, পুষ্টি উপাদান, কী পরিমাণ সার দিতে হবে এবং ওই মাটিতে কী ফসল ভালো হবে তা বলে দেবে।
এছাড়াও লিফ কালার পরীক্ষা করা সম্ভব।  পাতার রং‌য়ের উপর নির্ভর করে ইউ‌রিয়ার প‌রিমাণ নির্ধারন সম্ভব। এ‌টি পরীক্ষা করতে হবে অ্যা‌পের মাধ্যমে। যার ফলে অ্যাপ বলে দি‌বে যে এখানে ইউ‌রিয়ার প‌রিমাণ কত এবং ফলন ভাল হওয়ার নির্দে‌শিকা দিবে। অ্যাপে দেখানো হবে- এই  মা‌টিতে কোন ফসল চাষ করলে কত ফলন হবে এবং ভালো ফলনের জন্য কি কি নির্দে‌শিকা অনুসরণ করতে হবে তাও অ্যাপে পরামর্শ দিবে।

টোকিও বাংলা নিউজ: এই  অ্যাপের আর কি কি সু‌বিধা রয়েছে এবং এর ফিচার কি কি?

রেজাউল খান: আমাদের এই ‘মাটির প্রাণ’ অ্যাপ্লিকেশনে কৃষকদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃষকের স্বাস্থ্য। দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলে আমাদের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে সেসব প্রাথমিক চিকিৎসাগুলো সম্পর্কে জানতে পারবেন। এ ছাড়াও তারা মাঠে কীটনাশক প্রয়োগ সম্পর্কে, কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সার দেবেন সে বিষয়ে সব নির্দেশনাবলী পাবেন।
কৃষকরা যাতে তাদের অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, সে ব্যবস্থাও আছে। আমাদের এই অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে অঞ্চলের রেজিস্টার্ড কৃষকদের ফসলের অবস্থা, কি কি চাষাবাদ হচ্ছে সব তথ্য পাবেন এবং কৃষকদের দ্রুত তথ্য সরবরাহ করতে পারবেন।

টোকিও বাংলা নিউজ: কৃষকরা এই ডিভাইস ও অ্যাপ ব্যবহার করলে আর কি কি উপকার পাবে?

রেজাউল খান: আমাদের ডিভাইস ব্যবহা‌রের পর যে ডাটা অ্যাপে আসবে তা আমাদের ক্লাউডে ভ‌বিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করা থাকবে। এর ফলে পরের বছর একই  মা‌টিতে কোন ফসল চাষ করলে ফলন ভাল হবে তা অ্যাপে পরামর্শ দেয়া হবে। এই  সকল ডাটা সরকারের কর্তৃপক্ষের জন্যও সংরক্ষণ করা থাকবে। এতে সং‌শ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও বিবেচনা করতে পারবেন এবং প্র‌য়োজনে কৃষককে পরামর্শ দিতে পারবেন। এছাড়াও আমাদের অ্যা‌পের মাধ্যমে সরকা‌রের সং‌শ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কৃষকদের ম‌নিট‌রিংয়ের মধ্যে রাখতে পারবেন। এতে সহজের জানা যাবে যে-কোন কৃষক কোন ফসল চাষ করছেন, কোন এলাকায় কোন ধরনের ফসল বে‌শি উৎপা‌দিত হচ্ছে।

টোকিও বাংলা নিউজ: আপনাদের এই আ‌বিষ্কার এখন কোন পর্যায়ে আছে?

রাহাত উদ্দিন: প্রোটোটাইপ বানানো হয়ে‌ গেছে। আমাদের এই ডিভাইসটি চাঁদপুর ও কুমিল্লায় কৃষকদের মধ্যে পাইলটিং পর্যায়ে রয়েছে। আমাদের ইচ্ছা এটিকে সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের ছয় লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী ৩-৪ মাসের মধ্যে ভোক্তা বা কৃষকপর্যায়ে ব্যবহারের উপযোগী হিসেবে তৈরি করতে সক্ষম হবো। ডিভাইসটি কৃষকের হাতে যতটা স্বল্প মূল্যে সহজলভ্যভাবে তুলে দেয়া যায় সেভাবেই আমরা চিন্তা করছি।

রেজাউল খান: আমাদের এই ডিভাইসের ল্যাব রি‌পোর্ট প‌জি‌টিভ আসার পরই আমরা পাইলট করে‌ছি। খুব শিঘ্রই আমরা আমাদের উদ্ভাবনকে বা‌নিজ্যিক পর্যায়ে নিয়ে যাব। আমাদের উদ্ভাবনের ক‌পিরাইট রে‌জিস্ট্রেশন শেষ। প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করে‌ছি।

আর এ