- মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪

| বৈশাখ ১৭ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

আমার প্রথম প্রেম (পর্ব-১)

ইসরাত জাহান তানজিলা

প্রকাশিত: ২০:১৭, ১৪ এপ্রিল ২০২২

আমার প্রথম প্রেম (পর্ব-১)

আমি যখন প্রথম প্রেমে পড়ি তখন আমার বয়স ষোল, কলেজে পা দিয়েছি সবে। ভয়াবহ রকমের প্রেম। তাকে দেখলেই আমার বুকের ভিতর রণঢাক বেজে ওঠে, হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। আমি হেবলার মত তার দিকে তাকিয়ে থাকি, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখি। তিনি সীমান্ত ভাই। দেখতে সুন্দর, সুদর্শন। আমি নিশ্চিত এক হাজার পুরুষের ভীড়েও তার দিকে আপনার চোখ আগে যাবে। সীমান্ত ভাইয়ের প্রতি আমার এই গলা সমান হাবুডুবু খাওয়া প্রেমের শুরু হলো নীরা আপার গায়ে হলুদের দিন থেকে। নীরা আপা সীমান্ত ভাইয়ের বোন। আমরা পাশাপাশি বিল্ডিং-এ থাকি। পাশাপাশি বিল্ডিং-এ থাকার সুবাদে দুই পরিবারের মধ্যেকার সম্পর্ক বেশ ভালো। গায়ে হলুদের দিন সন্ধ্যায় কালো রঙের একটা পাঞ্জাবি পরে গিটার হাতে কি চমৎকার করে গান গাইলেন সীমান্ত ভাই। গানের দিকে আমার কোনো মনোযোগ ছিলো না। আমি সেদিন মুগ্ধ হয়ে সীমান্ত ভাইকে দেখেছি কেবল। কি দারুণ তিনি! কি অপূর্ব তার গলা! আমি চট করে প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রেমে পড়ে আমার অবস্থা করুণ হয়ে গেল। চোখের ঘুম উড়ে গেল। আমি নিশ্চিত ওখানে উপস্থিত প্রায় সব মেয়ের রাতের ঘুম তিনি সেদিন কেড়ে নিয়েছিলেন। প্রেমে পড়ার শুরু সেই থেকে। এখন প্রতিনিয়ত তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। আমার এই উথালপাথাল প্রেম, ব্যাকুলতা, অস্থিরতা সবটাই সীমান্ত ভাইয়ের অজানা। কত রাত তাকে নিয়ে ভেবে নির্ঘুম কাটাচ্ছি। 

আমি জেনিথ। পুরো নাম নৌশিতা রহমান জেনিথ। দেখতে আহামরি সুন্দরী না আবার অসুন্দর বলাও চলে না। গায়ের রং উজ্জল, উচ্চতা মাঝারি। দেখতে খানিকটা মোটাসোটা। মাথাও ততটা ভালো না, টেনেটুনে পাশ করি পরীক্ষায়। মানুষ হিসেবে আমি ভীষণ একগুঁয়ে, জেদি, প্রতিশোধপরায়ণ। কেউ আমাকে একটু কষ্ট দিলে আমি তাকে অনেকখানি কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করি। কেউ আমাকে কাঁদালে আমিও তাকে না কাঁদিয়ে ছাড়ি না। এগুলো অবশ্য গুণ নয় দোষ। সে আমি জানি। নিজের দোষ-গুণ অকপটে স্বীকার করার সাহস আমার আছে।আমার যা করতে ইচ্ছে হয় আমি তাই করি। আমার যা ভালোলাগে আমি তা পেয়েই ছাড়ি। জোর করে হলেও। এবার আমার গুনের কথা বলি। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্যি যে সারাজীবন খুঁজে খুঁজে আমি আমার একটা গুনই পেয়েছি। সেটা হলো আমি ভালো রান্না করতে পারি। যে একবার আমার রান্না খেয়েছে সে অনেকদিন মনে রেখেছে। 

আমি খুব ছোট থাকতে আমার মা-বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। তারা দুইজনই ডাক্তার ছিলেন। আমার বাবার বিশাল সম্পত্তির একমাত্র মালিক আমি। বড় হয়েছি নানা বাড়িতে। নানা-নানুর হাতে মানুষ। আমার তিন মামা-মামী, তাদের ছেলেপুলে আর নানা-নানী সবাই একত্রে থাকে। যৌথ পরিবার। আজকাল এত বিশাল পরিবার খুব একটা দেখা যায় না। এবাসায় সারাদিন হাউকাউ, হৈ হুল্লোড়, চেঁচামেচি লেগেই থাকে। আমি বেশিরভাগ সময়ই দরজা আটকে রুমে বসে থাকি। আমার রুমে নানু ছাড়া কেউ আসে না। কারণ এবাসার প্রায় সবাই আমাকে মনে মনে অপছন্দ করে, ঈর্ষা করে। আমার মামীরা সামনে সামনে আমাকে ভালোবাসার ভান করলেও যে তারা আমাকে ততটা ভালোবাসে না সে আমি জানি। আমার মামাতো ভাই-বোনদের সাথেও আমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো না। সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কারণটা পরিষ্কার। এ বাসায় আমার আধিপত্য, দাপট সবার থেকে বেশি। একারণেই ওরা আমাকে অপছন্দ করে। ওসব নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র বিচলিত নই। আমি কাউকে পাত্তা দিয়ে চলি না। এ বাসার প্রধান হর্তাকর্তা, সর্বেসর্বা আমার নানু। বাসার প্রতিটি মানুষ তাকে ভয় করে। ছোটবেলা মা-বাবাকে হারানোর কারণে নানু আমায় পরম আদর, ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করেছেন। আমার জন্য তার অন্য রকম স্নেহ, সহানুভূতি রয়েছে। কখনো আমার অযত্ন, অবহেলা করেননি। আমার অন্যায় আবদারও  হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। আমি তার চোখের মণি। তাই আমাকে কিছু  বলার সাহস কারো নেই। মেজো মামার ছেলে নিষাদ একবার ঝগড়ার সময় আমাকে বলেছিল, তুমি আমাদের বাসায় থেকে আমার সাথে ঝগড়া করো। আমাদের বাসা থেকে চলে যাও। কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে ঘুষি মেরে ওর মুখ থেঁতলে দিয়েছিলাম আমি। বেচারা এখন আমার ধারেকাছেও আসেনা। নানা-নানু না থাকলে যে এ বাসায় আমার অবস্থা নড়বড়ে হয়ে যাবে, মামা-মামী, মামাতো ভাইবোনেরা আমার সাথে দুর্ব্যবহার করবে তা আমার অজানা নয়। তবে এসব নিয়ে আমি চিন্তিত না। আমার জন্মের পরই আমার বাবা আমার নামে একটা বাড়ি লিখে দিয়েছিলেন। তাছাড়াও আমার বাবার আরো দুইটা বাড়ি রয়েছে। আমি আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি নানা-নানু মারা গেলে আমি এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো।

কলেজ থেকে এসে গোসল না দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। শরীর ভীষণ ক্লান্ত লাগছিলো। ঘুম ভাঙতেই সীমান্ত ভাইয়ের গলা শুনলাম। তিনি কোনো প্রয়োজন ছাড়া আমাদের বাসায় আসেন না। আজ হঠাৎ কি প্রয়োজন পড়লো? আমার বুকের ভিতর ধুকপুক করে ওঠে। আমি চট করে বিছানা ছাড়লাম। আমাকে দেখতে ভয়ঙ্কর লাগছে। এলোমেলো চুল, মুখে তেলতেলে ভাব। এই অবস্থায় সীমান্ত ভাইয়ের সামনে আমি যেতে পারবো না। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে ভালো একটা থ্রিপিস পরে নিলাম। গায়ে সুন্দর ঘ্রাণের একটা পারফিউম মেখে বড় বড় পা ফেলে ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখলাম সেখানে সীমান্ত ভাই নেই। আমি দুঃখ পেলাম। সীমান্ত ভাইয়ের গলা স্পষ্ট শুনেছি। তিনি কি চলে গেছে? এই সামান্য বিষয়টায় আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। এমন আগে কখনো হয়নি। নিষাদ সোফায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে টিভি দেখছে। সেই ঘুষির পর থেকে আমার সাথে কথা বলে না। আমি ওর পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম,
--কিরে সীমান্ত ভাই আসছিলো? তার গলা শুনলাম।

বেচারা ভীষণ রাগ করে আছে আমার উপর। আমার কথার উত্তর দিলো না। উত্তর না দেওয়ায় আমি ওর কান টেনে ধরলাম। নিষাদ ব্যথার চোটে লাফিয়ে ওঠে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
--জেনিথ আপা তুমি খুব খারাপ। খুব। আমাকে সব সময় মারো।

এই ছেলে মায়ের মত অল্পতেই কেঁদে দেওয়ার স্বভাব পেয়েছে। 
--আমি খারাপ এটা তুই নতুন জানিস? তুই আমার কথার উত্তর দিস নাই, নানুকে বলবো গিয়ে?

--যাও বলো গিয়ে। এ বাসায় তুমি আর তোমার নানুই সব। আমরা কেউ না।

--এসব কথা তোকে তোর মা শিখায়? তুই আবার মার খাবি। বড় বড় কথা না বলে যা জিজ্ঞেস করছি উত্তর দে।

--হ্যাঁ, আসছিলো সীমান্ত ভাইয়া। সুরভী আপা তার কাছে গান শিখবে।

প্রথমে কিছুক্ষণ আমি অবাক হয়ে রইলাম। তারপর ধীরে ধীরে আমার রাগ হতে লাগলো। দুনিয়াতে গানের শিক্ষকের অভাব পড়েছে?  সীমান্ত ভাই কেবল শখের বশে গান করে। সে কি গানের শিক্ষক যে সুরভী আপাকে গান শিখাবে? সুরভী আপা আমার বড় মামার মেয়ে। অনার্সে পড়ে। আমার তিন ক্লাস বড়ো। দেখতে খুব সুন্দরী। কতশত ছেলে তার প্রেমে ব্যাকুল। সুরভী আপাও যে কত ছেলের সাথে প্রেম করে হিসেব নেই। 
আমার মাথাটা ধরে গেল রাগে। সুরভী আপা বেশ ভালো গান জানে। এই বয়সে তার মাথায় আবার নতুন করে গান শেখার ভুত কোত্থেকে চাপলো! তাও আবার সীমান্ত ভাইয়ের কাছে! আমি চড়া মেজাজে সুরভী আপার রুমের দিকে গেলাম। গিয়েই অত্যন্ত বিরক্তভরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,
--তুমি না-কি সীমান্ত ভাইয়ের কাছে গান শিখবে নিষাদ বললো।

--আরে না। আমার ভার্সিটিতে একটা অনুষ্ঠান আছে। আমি সেখানে গান করবো। তার জন্য একটু রেওয়াজ করতে চাচ্ছি সীমান্ত ভাইয়ের কাছে। তিনি তো এসবে পাকা।

বিষয়টা আমার হজম হচ্ছে না। সহজ ভাবে বলতে গেলে আমি ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়লাম। এই গান-টান শিখাতে গিয়ে যদি অতি রূপবতী সুরভী আপার প্রেমে পড়ে যায় সীমান্ত ভাই? আমি কোনভাবে রাগ চাপিয়ে বললাম,
--সীমান্ত ভাই কি গানের শিক্ষক? কোনো গানের শিক্ষকের কাছে শিখলেই তো পারো। 

সুরভী আপা কোনো উত্তর দিলো না। আমি আবার বললাম,
--সীমান্ত ভাইয়ের কাছে তুমি গান শিখতে পারবে না। অন্য কারো কাছে গিয়ে শিখো।

সুরভী আপা ভীষণ অবাক গলায় বলল,
--মানে? তোর কি সমস্যা জেনিথ? 

--আমার সমস্যা আমি তোমাকে বলবো না। 

--বলবি না তো আমার রুম থেকে যা। সব ব্যাপারে অযথা ঝামেলা করা তোর স্বভাব হয়ে গেছে। 

এ পর্যায়ে আমার বলে দিতে ইচ্ছে হলো সীমান্ত ভাইকে আমি ভালোবাসি। তুমি তার কাছে গান শিখবে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগবে না। কিন্তু বলতে পারলাম না। আমি চাইনা এই বিষয়টা এ বাসার কেউ জানুক। জানাজানি হলে বিশ্রী কাণ্ড হবে। তারা আড়ালে আবডালে এটা নিয়ে নিন্দা করবে। প্রেমের কথা সবাই ই গোপন রাখতে চায়, এ ব্যাপারে আমিও ব্যতিক্রম না।

আমি কঠিন গলায় সুরভী আপাকে বললাম,
--আমি বড়ো মামার কাছে গিয়ে এখনই বলে দিবো যে এলাকার ওই বখাটে নাদিমের সাথে তোমার প্রেম। তার সাথে ঘুরতে যাও। আমার কাছে তোমাদের ছবিও আছে। আমি তাও দেখাবো।

এটা বলেই আমি রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালাম। সুরভী আপা দৌড়ে এসে আমার হাত টেনে ধরলো। ভয় ভয় গলায় বলল,
--আব্বুর কাছে এসব বলিস না প্লীজ। 

তারপর অসহায় ভাবে নমনীয় গলায় বলল,
--সীমান্ত ভাইয়ের কাছে গান শিখলে তোর কি সমস্যা বল? সব সময় কেন এমন করিস জেনিথ?

--দুনিয়ার সকলকে রেখে তুমি সীমান্ত ভাইকে ধরছো গান শেখার জন্য। কেন? তোমার মতলব কি? সীমান্ত ভাইয়ের উপর নজর পড়েছে তোমার? খবরদার! তুমি তার দিকে তাকাবেও না ফের; গান শেখা তো দূর।

আমি সুরভী আপার রুম থেকে চলে আসলাম। সীমান্ত ভাইয়ের কাছে গান শেখার ব্যাপারটা ভেস্তে দিলাম। সুরভী আপা আমার সম্পর্কে কি ভাবছে? আমি সীমান্ত ভাইকে পছন্দ করি? ভাবুক! আমি চেয়েছি কিন্তু পাইনি, এমন কোনো ঘটনা কখনো ঘটেনি। সেখানে জীবনে প্রথম আমি একজনকে ভালোবেসেছি। তারও আমাকে ভালোবাসতে হবে, বাসতেই হবে।

চলবে.....
 

 

আর এ