- শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪

| জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

বাংলাদেশে নদী দখল করে প্রভাবশালীদের মাছ চাষ

মহি ইউ খান মামুন, ঢাকা

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ৬ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশে নদী দখল করে প্রভাবশালীদের মাছ চাষ

বাংলাদেশে নদী দখল করা, দূষণ ছড়ানো এসব ফৌজদারি অপরাধ। এ জন্য রয়েছে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান। পাশাপাশি নদীরক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রয়েছে আদালতের রায় ও নির্দেশনা। তবু দেশটির নদীর ওপর নির্যাতন বেড়ে চলছে। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে দখলদার। পানি হচ্ছে দূষিত থেকে দূষিততর।

ভারত সীমান্ত সংলগ্ন নদী ইছামতি। নদী পাড়ের হালদার সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর জীবন জীবিকা এই নদীকে ঘিরে। মাছ ধরে বিক্রি করে তাদের জীবন চলে। যে নদীটি এলাকার মানুষ মাছ ধরা থেকে শুরু করে নানা কাজে ব্যবহার করেন। সেই নদীতে হঠাৎ করে স্থানীয় এক প্রভাবশালী বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করেছেন। মহেশপুর উপজেলার শ্রীনাথপুর গ্রামের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদীতে এই বাঁধ দেয়া হয়েছে। 

স্থানীয়রা বলছেন, বছরের পর বছর এই নদীর সরকারি জায়গা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। গ্রামের মানুষ নদীর পানিতে গোসল থেকে শুরু করে যাবতীয় অনেক কাজই করতো। এখন বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করার কারণে কাউকে নদীতে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। নদীর পানিতে গোসল করা যাবে না বলে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। হালদারদের মাছ ধরারও কোনো সুযোগ নেই।

হালদারপাড়ার সাধন হালদার জানান, তারা প্রায় ১৭ টি পরিবারে শতাধিক মানুষ এই নদীর পাড়েই বসবাস করেন। এছাড়াও গ্রামে আরো হালদার সম্প্রদায় রয়েছে। যারা এই নদীতে মাছ ধরে বিক্রি করেন। এই মাছ বিক্রির মাধ্যমে তাদের সংসার চলে। এই বাঁধ দেওয়ার কারণে তারা আর নদীতে নামতে পারছেন না। তিনি বলেন, শরিফুল ইসলামের এক ভাই স্থানীয় ইউপি সদস্য। যে কারণে শরিফুল কোনো কিছুই মানতে চান না। তাদের সমস্যার কথাগুলো বলেছেন, কিন্তু তিনি গুরুত্ব দেননি। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন হালদার সম্প্রদায়ের মানুষগুলো।

এ বিষয়ে দখলকারি শরিফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, নদীতে এখন পানি কম। তিনি খাবার জন্য কিছু মাছ ছেড়ে বড় করছেন। এটা তিনি শুনে করেছেন, কিন্তু কাদের কাছে শুনেছেন তা বলতে চাননি। তিনি নিজের ঘাড়ে দোষ নিয়ে বিষয়টির দিকে একটু খেয়াল রাখার অনুরোধ করেন। নদীতে মানুষের নামতে নিষেধ একথা ঠিক নয় বলে জানান।

পদ্মার শাখা বড়াল নদীতে এখন পানি প্রবাহ বন্ধ। এই সুযোগে নদীতে বাঁধ দিয়ে পুকুরের মতো আয়তন করে মাছ চাষ করছেন স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। অথচ এই নদীর মাছ বিক্রি করেই চলত দুপাড়ের জেলে পরিবারগুলোর সংসার। কিন্তু এখন তাঁরা আর নদীতে নামতে পারছেন না। এতে পরিবার নিয়ে জেলেরা অসহায় জীবনযাপন করছেন। 

স্থানীয়রা জানান, দখলদারদের সবাই প্রভাবশালী। গত মাসে পানি প্রবাহ বন্ধের পরপরই তারা প্রভাব খাটিয়ে উপজেলার বড়ালের উৎসমুখ থেকে অনুপমপুর ও মুংলি হয়ে কালুহাটি পর্যন্ত ১০ কিলোমিটার এলাকায় অন্তত ২০টি ভাগে ভাগ করে মাটি দিয়ে ভরাট করাসহ বাঁশের চাটাই, কচুরিপানা, জাল দিয়ে বাঁধ দিয়ে জবরদখল করে মাছ চাষ শুরু করছেন। 

এদের দখলে থাকা নদীতে মাছ ধরতে গেলে নদীপাড়ের মৎস্যজীবী বাসিন্দা অনুপমপুর গ্রামের এজারুল ইসলামের ছেলে সুমন আলী ও মিয়াপুরের আশকান আলীর ছেলে পিন্টুকে মারধর করা হয়। এ জন্য দখলদারদের ভয়ে সাধারণ মানুষ নদীতে নামতে পারছেন না। 

চারঘাট উপজেলা নদী রক্ষা কমিটির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সাইফুল ইসলাম বাদশা জানান, পুরো বড়াল নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীকে পুকুরের মতো করে ফেলা হচ্ছে। মুরগির বিষ্ঠাসহ নানা রকম রাসায়নিক সার দিয়ে নষ্ট করা হচ্ছে পানি। দখলদাররা নদীতে কাউকে নামতে দিচ্ছে না। পানিতে নামার মতো কোনো পরিবেশও রাখা হয়নি।

চারঘাট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়ালিউল্লাহ মোল্লাহ বলেন, 'আইন ভেঙে নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে দেশীয় প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম। এ ব্যাপারে উপজেলা মৎস্য অফিস প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।'

বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে দেশের ১১৫টি নদ-নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায়। অন্য দিকে নদী, পানি-প্রকৃতি নিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ, ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, 'সরকার যে প্রতিশ্রুতি দেয়, তা রাখার দায়িত্ব সরকারের। সরকার চালান ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় সরকার চালান রাজনৈতিক নেতা ও মাস্তানরা। নদীও দখল করে রেখেছে তারা। তাহলে কে কাকে উচ্ছেদ করবে?' তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে নীতি, আইন, পরিসংখ্যান সব আছে। কিন্তু প্রয়োগ নেই।'

অধ্যাপক আইনুন নিশাত জানান, ২০১১ সালে সংবিধানে কিছু পরিবর্তন আনা হয়। সেখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতি, জলাভূমি, বনভূমি, জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। এটির খসড়া সংসদে যাওয়ার পর 'নদী' শব্দটিও ছিল। কিন্তু সেখান থেকে সংসদ সদস্যরা 'নদী' শব্দটি বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, সংবিধান রাষ্ট্রযন্ত্রকে যে দায়িত্ব দিয়েছে যেটি রাষ্ট্রযন্ত্র না মানলে সাধারণ মানুষের কিছুই করার নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। কারণ নদী দিয়েই এ দেশের সৃষ্টি। আমাদের নদীগুলোকে আমাদের নদীর মতোই রাখতে হবে। দেশের উন্নয়নকে নদী ও পরিবেশকেন্দ্রিক করতে হবে।

দেশের নদ-নদীর ভবিষ্যত্ এবং মানুষের ওপর এর প্রভাব নিয়ে দেশের জনগণ বরাবরই উদগ্রীব। পরিবেশবাদী বেশকিছু সংগঠন নদী দখল ও দূষণ নিয়ে আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু দখলকারীদের টনক নড়তে দেখা যায়নি।

 

আর এ/ এম ইউ কে