- শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪

| জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১ -

Tokyo Bangla News || টোকিও বাংলা নিউজ

জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব

মহি ইউ খান মামুন:

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশে এর ক্ষতিকর প্রভাব

গোটা বিশ্বে জলবায়ুর প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশে এর প্রভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ এমন এক মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টি নেই, আবার অসময়ে অতিবর্ষণ, অতি বজ্রপাত। আবহাওয়া আর প্রকৃতির গতি-প্রকৃতি বুঝে ওঠা দায় হয়ে পড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে তার চরিত্র। প্রকৃতি বিচিত্র ধরনের আচরণ করছে।

যথাসময়ে শীত আসছে না, বৈশাখে আষাঢ়ের আচরণ, শরৎ-এ বর্ষার রূপ, গরমে শীত শীতভাব, বর্ষায় বৃষ্টি কম, অতি খরা, অতি বৃষ্টি এমনটাই হচ্ছে। আবহাওয়ার এই ধরন দেখে বোঝার উপায় নেই প্রকৃতিতে কখন কোন ঋতু বিরাজ করছে। প্রকৃতি এমন আচরণ করছে কেন? আবহাওয়া বদলে যাচ্ছে কেন? এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। পরিবেশ দূষণের কারণে মূল চরিত্র বদলাচ্ছে সব ঋতু।

এখন শরৎকালতেও ঝরছে বৃষ্টি। বৃষ্টি না থাকলে তাপমাত্রা ৩৫/৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ওঠে। শরৎ-এর আশ্বিনে এ কেমন গরম! আশ্বিনের এমন বৃষ্টি যেন বাঙালির আকাশ কুসুম ভাবনা। আবার হুট করে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ সড়কে উপচে পড়া পানি।

প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। সমতল এবং নীচু ভূমি, জনসংখ্যার ঘনত্ব, দারিদ্র্যের উচ্চ হার, জলবায়ু সংবেদনশীল খাত, বিশেষ করে কৃষি ও মৎস্যসম্পদে অনেক জীবিকার নির্ভরতা এবং অদক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার কারণে ঝুকিরমাত্রা অনেকাংশে বেড়ে গেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব যেমন সমুদ্রপৃষ্ঠের উ”চতা বৃদ্ধি, উচ্চ তাপমাত্রা বর্ধিত মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি, বিদ্যমান সমস্যাগুলিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে যা ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। এছাড়াও বিপুল সংখ্যক জনসংখার দেশে প্রতিকূল পরিবেশ পানি ও খাদ্য নিরাপত্তা হ্রাস করে । এসব প্রভাব দেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, জাতীয় উন্নয়ন এবং জনগণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে।

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এসব বিপর্যয় জাতিকে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এছাড়াও কৃষির উপর নির্ভরশীল অর্থনীতি, প্রতিকূল আবহাওয়া সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে বিপন্ন করে তুলছে।

২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তাপমাত্রা প্রায় ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। ২০৪০ -২০৫৯ সালের মধ্যে, বার্ষিক বৃষ্টিপাতও ৭৪ মিলিমিটার বৃদ্ধি হতে পারে জলবায়ূবিদরা আশংকা করছেন। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিস্থিতি তীব্র হওয়ার সাথে সাথে আরও বেশি লোক তাদের বাড়িঘর এবং জমি থেকে বিতাড়িত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উ”চতা বৃদ্ধি, ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, খরা, ভাঙন, ভূমিধস এবং বন্যা ইতোমধ্যেই বিপুল সংখ্যক মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে।

নদ-নদীতে লোনা পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে, বাড়বে শরণার্থীর সংখ্যা। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে এবং দেশে বিশুদ্ধ পানির সংকট বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হেপাটাইটিস বি, সংক্রামক ব্যাধি, মেনিনজাইটির মতো গ্রীষ্মকালীন রোগগুলো বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে সূর্যের বিকিরণকৃত আলটাভায়োলেট রশ্মিও অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কারণে চামড়ার ক্যান্সার ও চোখের ছানি পড়া রোগ বৃদ্ধি পাবে।

এমনকি খাদ্যশস্যে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যাবে। খাদ্যাভাব দেখা দেবে। এই অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ বিপর্যয়কে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়ংকর অপ্রথাগত হুমকি বলে বিবেচনা করা হচ্ছে। এমন শঙ্কার খবরগুলো ভাবায় বৈকি!

বিশ্ব যেভাবে চলছে, তাতে উষ্ণতা বৃদ্ধি এড়ানো বড়ই কঠিন। তাতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই ব্যাপারে আমাদের বসে থাকলে চলবে না। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। গবেষকদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ঋতুচক্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে ঝুঁকিতে পড়ছে কৃষি, বাড়ছে দুর্যোগ ও নতুন রোগের বিস্তৃতি ঘটছে।

এছাড়া বন্যা ও লঘুচাপের পরিমাণও বেড়েছে। ‘জলবায়ু সেবা পরিস্থিতি ২০২০’ শীর্ষক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্যা-সাইক্লোনসহ নানা দুর্যোগে বাংলাদেশে ৪০ বছরে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্লাইমেট সেন্ট্রালের গবেষণায় বলা হয়েছে, আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বন্যার আঘাতের শিকার হবে বাংলাদেশের ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ।

আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, সাধারণত আগস্টে বঙ্গোপসাগরে দুই থেকে তিনটি লঘুচাপ হয়। কিন্তু এই বছর হয়েছে পাঁচটি। সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের 'বাংলাদেশের জলবায়ু' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, কয়েক বছরে স্বাভাবিকের চেয়ে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি বৃষ্টি হয়েছে। রংপুরে ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে চলতি বছর।

বাংলাদেশ এমন এক মহাবিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টি নেই, আবার অসময়ে অতিবর্ষণ। শীতে নেই শীত। শুষ্ক মৌসুমে মারাত্মক খরা শস্যহানি; আবার প্রলয়ঙ্করী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পৌনঃপুনিকতা। ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশে ঋতু-বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে।

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে নদীভাঙনের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহুরে বস্তিতে বসবাসরত মানুষের মধ্যে ৫০ ভাগই নদীভাঙনের শিকার ফলে তারা তাদের গ্রামীণ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এছাড়াও উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে গ্রীষ্মমন্ডলীয় ঝড়ের ক্রমবর্ধমান তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা মানুষের জীবনহানিসহ ঘরবাড়ি, সম্পত্তি ও অবকাঠামোর ক্ষতি এবং কৃষি ও অন্যান্য জীবিকাকে ব্যাহত করে।

এছাড়াও প্রতিদিন ১০০০-২০০০ লোক বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমায়। ২০১২ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যায় যে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ১৫০০টি পরিবার অভিবাসনের জন্য পরিবর্তিত পরিবেশকে প্রধান কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে।


জলবায়ূ সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আশানুরূপ ফল বয়ে আনতে পারে। বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভের সংরক্ষণের পাশাপাশি পুনরায় বৃক্ষ রোপণ করতে পারে, যেটি পরিবেশকে কার্বনমুক্ত করার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে একটি প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবেও কাজ করবে। কিন্তু এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল, কারণ এই ব্যবস্থায় প্রতিবছর প্রায় ৪০ কিলোমিটার উপকূলরেখায় ম্যানগ্রোভ রোপণ করতে হবে।

এছাড়াও আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা তৈরি করা এবং আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা, ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে যেখানে মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে। অনেকে বর্তমান আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ব্যবহার করে না, কারণ সেখানে তারা তাদের গবাদিপশু ও অন্যান্য মূল্যবান প্রাণিসম্পদ রাখার ব্যবস্থা করতে পারে না, তাই প্রস্তাবিত কাঠামো মানুষ এবং গবাদিপশু উভয়ের বাসস্থানের ব্যবস্থা করবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় ৫৩০টি আশ্রয়কেন্দ্রের প্রয়োজন।

পরিবেশ সচেতন হওয়ার সময় এখনই। আমাদের জনগণ আমাদের পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে। কেবল সরকারের পক্ষেই পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়; জনগণকেও এই বিষয়ে সচেতন হয়ে পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে। এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে নদীভাঙন, জলোচ্ছ্বাস, দীর্ঘমেয়াদি বন্যা, জলাবদ্ধতা, খরা, অতিরিক্ত লবণাক্ততা এসব সমস্যা এখন প্রকট। এসব সমস্যার কারণে প্রতি বছর দেশের লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এই অবস্থায় জলবায়ু ও দেশে পরিবেশ রক্ষায় সরকার আরও বেশি সচেষ্ট হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এম কে এম